Monday, March 25, 2019

অপারেশন সার্চলাইট’ ও একটি “পরিকল্পিত” গণহত্যা


বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এমন ভয়ানক রাত আগে কখনো আসেনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত। শুরু হলো বাঙালি জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এক পরিকল্পিত সামরিক অভিযান, যার নাম অপারেশন সার্চলাইট। অপারেশন সার্চলাইটকে নিছক বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের একটি সামরিক চেষ্টা এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল এক ভয়াল গণহত্যার নীলনকশা, গোপনে গোপনে যার প্রস্তুতি চলছিল বেশ আগে থেকেই।
.
অপারেশন সার্চলাইটের সিদ্ধান্ত হয়েছিল একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত সাংবাদিক রবার্ট পেইনের “ম্যাসাকার” বইতে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এক সামরিক বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের খতম করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সেনা বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘Kill three million of them, and the rest will eat out of our hands।’
.
এর ফলে পাকিস্তান বাহিনীর ১৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা এবং ৫৭ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি সামরিক অভিযানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন।
.
১৭ মার্চ চীফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খানের নির্দেশে জেনারেল রাজা পরদিন ঢাকা সেনানিবাসে জিওসি অফিসে অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। পাঁচ পৃষ্ঠার এই পরিকল্পনাটি রাও ফরমান আলী নিজ হাতে লেখেন।
.
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২৪-২৫ মার্চ জেনারেল হামিদ, জেনারেল এ. ও মিঠঠি, কর্নেল সাদউল্লাহ হেলিকপ্টারে করে বিভিন্ন সেনানিবাসে প্রস্ত্ততি পরিদর্শন করেন। সিদ্ধান্ত হয়, ২৫ মার্চ রাত ১টায় অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় অভিযানে ঢাকায় নেতৃত্ব দেন জেনারেল রাও ফরমান আলী। এই জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ডায়রিতে লিখেছিলেন, ‘paint the green of East Pakistan red’।
.
পরিকল্পনা মোতাবেক দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নেতৃত্ব দেন জেনারেল খাদিম রাজা। লে. জেনারেল টিক্কা খান ৩১ ফিল্ড কমান্ডে উপস্থিত থেকে অপারেশনের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেন। এ ছাড়া এ অভিযানকে সফল করার জন্য ইতোমধ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের দু’জন ঘনিষ্ঠ অফিসার মেজর জেনারেল ইখতেখার জানজুয়া ও মেজর জেনারেল এ.ও মিঠঠিকে ঢাকায় আনা হয়।
.
অপারেশন সার্চলাইট অভিযান শুরুর সময় নির্ধারিত ছিল ২৬ মার্চ রাত ১টা। কিন্তু ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তাঁর বৈঠকে কোনো ইতিবাচক ফলাফল না পেয়ে সবাইকে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য তৈরি হওয়ার আহবান জানান। বঙ্গবন্ধুর আহবানে সে রাতেই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিকামী বাঙালি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এরই ফলশ্রুতিতে দুটি সিদ্ধান্ত হয়- (এক.) অপারেশন বিগ বার্ড (দুই.) গণহত্যা অভিযানের সময় এগিয়ে আনা। অপারেশন বিগ বার্ড ছিলো বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার অভিযান। ঐ দিন রাত ১.৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
.
সম্ভাব্য কোন এক আক্রমণের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুও আঁচ করতে পেরেছিলেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের আগের দিন, অর্থাৎ ২২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে বৈঠকে কর্নেল ওসমানী বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘Do you think tomorrow that will be a crucial day?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, ‘No, I think, it will be twenty fifth।’
.
১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত শ্বেতপত্রেও এ পরিকল্পিত গণহত্যার ইঙ্গিত আছে। সেখানে বলা হয়, আওয়ামী লীগ ২৬ মার্চ ভোরে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ও এ.এ.কে নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেকের মতে, বাঙালি বিদ্রোহীদের প্রবল প্রতিরোধ সৃষ্টির আগেই পাকিস্তান বাহিনী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পৌঁছার লক্ষ্যে অভিযান এগিয়ে ২৫ মার্চ রাত ১১-৩০ মিনিটে অভিযান শুরু করে। ঐ শ্বেতপত্রে ২৫ মার্চ সামরিক অভিযানকে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়।
.
২৫ মার্চ গণহত্যা শুরুর প্রাক্কালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান করাচির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। কিন্তু অভিযান প্রত্যক্ষ করার জন্য পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্
টাল হোটেলে থেকে যান। পরদিন ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে ভূট্রো সেনাবাহিনীর পূর্ব রাতের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে মন্তব্য বলেছিলেন, ‘আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ যে পাকিস্তানকে রক্ষা করা গেছে।’ আজ তাই তাকে বলতে ইচ্ছে করে, ‘ভুট্টো সাহেব, পাকিস্তান সেদিন রক্ষা পায়নি, আজও নয়’। #Md_Alauddin_Vuian
.
২৫ মার্চ অভিযানের আগেই বিদেশি সাংবাদিকদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। দেশি সংবাদপত্রের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকায় এ সম্পর্কে তেমন বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লুকিয়ে থাকা তিন বিদেশি সাংবাদিক- - আর্নল্ড জেটলিন, মাইকেল লরেন্ট, সাইমন ড্রিং-এর লেখনী থেকে সে রাতের পরিকল্পিত ভয়াবহ, বর্বোরোচিত গণহত্যার অনেক তথ্যচিত্র পাওয়া যায়।
.
২৫ মার্চে গণহত্যার আর একটি বড় প্রমাণ সে সময়ে ঢাকায় কর্মরত মার্কিন দূতাবাসের কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড কর্তৃক মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে লেখা টেলিগ্রামগুলো। আর্চার ব্লাড তাঁর লেখা অধিকাংশ টেলিগ্রামে সে সময়ে বাংলাদেশের গণহত্যাকে “নির্বাচিত” গণহত্যা বলেছেন যার সূত্রপাত ঘটেছিল ২৫ মার্চ সেই কাল রাত্রিতে।
.
দুটি বিশেষ কারণে ২৫ মার্চের গণহত্যা আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবী রাখে- এটি একটি পরিকল্পিত গণহত্যা ও স্বল্প সময়ে এ চেয়ে বেশী সংখ্যক গণহত্যার নজির নেই। ’৮১তে জাতিসংঘের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ‘Among the genocides of human history, the highest number of people killed in lower span of time is in Bangladesh in 1971. An average of 6000 (six thousand) to 12000 (twelve thousand) people were killed every single day. …This is the highest daily average in the history of genocides…’
.
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো যে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ইতিহাসে সত্য লুকিয়ে থাকতে পারে, সত্য চাপা রাখা যায়; কিন্তু সত্যকে বিলীন করা যায় না। সময়ের সাথে সাথে ইতিহাস সবাইকে তার যোগ্য প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে থাকে। বঙ্গবন্ধু, ম্যান্ডেলা, গান্ধিজী, আব্রাহাম লিঙ্কন –ইতিহাস এদেরকে যেমন মহিমান্বিত করেছে তেমনি রোমান সম্রাট ক্যালিগুলা, কম্বোডিয়ার পলপট, জার্মানির হিটলার, রাশিয়ার স্ট্যালিন, উগান্ডার ইদি আমিন, রোমানিয়ার চসেস্কু, চীনের মাও সেতুং, লিবিয়ার গাদ্দাফি, পাকিস্তানের ইয়াহিয়া, জুলফিকার আলী ভুট্টো … ইতিহাস এদের কাউকেই ক্ষমা করেনি।

0 comments:

Post a Comment